গাছপালার সবুজ ছায়ায় ঢাকা, বাঁশ-বেত আর পলিমাটির সৌন্দর্যে গড়া বিদ্যালয় দেখলে মনে হবে যেন আধুনিক যুগের শান্তিনিকেতন! এখানে শিশুরা মনের উল্লাসে জ্ঞানার্জন করে, প্রকৃতির কোলে শেখে হাতে-কলমে। বলছি, বাঁশ, মাটি, খড়, নারকেলের দড়ি, তালপাতার ছাউনি —দিয়ে দেশীয় উপকরণে নির্মিত এক নিখাদ বাঙালি স্থাপনা এক বিদ্যালয়ের কথা। এর নাম দীপশিখা মেটি স্কুল। ২০০৭ সালে দিনাজপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত এই স্কুল ‘আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার’ পায়।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের রুদ্রাপুর গ্রামে অবস্থান বিদ্যালয়টির। যদিও রুদ্রাপুর বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম, দীপশিখা মেটি স্কুলের সৌন্দর্য ও অনন্যতার কারণে এটি এখন দেশবিদেশের মানুষের কাছে সুপরিচিত। নিয়মিত পর্যটকরা ছুটে আসেন এই স্কুলের মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলী প্রত্যক্ষ করতে।
এই অনন্য বিদ্যালয়টির মেঝের প্লাস্টারে পামওয়েল ও সাবানের পেস্ট ব্যবহৃত হয়েছে, যা সাধারণত জলরোধী। ৯ ফুট উচ্চতার প্রথম তলার ছাদে বাঁশের বিছানার ওপর বাঁশের চাটাই বিছিয়ে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষার জন্য উপরে টিনের আচ্ছাদন রয়েছে। দীপশিখা মেটি স্কুলটি ৬টি কক্ষবিশিষ্ট, মাটির তৈরি একটি দ্বিতল ভবন, যার আয়তন আট হাজার বর্গফুট।
এই ভবন নির্মাণে ব্যয় হয় মাত্র সতেরো লাখ টাকা, যেখানে ইট-সিমেন্টের অনুরূপ একটি ভবন তৈরিতে খরচ হতো নব্বই লাখ থেকে এক কোটি টাকা।
দ্বিতল এই বিদ্যালয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এর কক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীরা গ্রীষ্মের তাপ বা শীতের শীতলতা তীব্রভাবে অনুভব করে না। পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের সঞ্চারণে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে, এবং কক্ষগুলো পরিবেশবান্ধব।
২০০৫ সালে জার্মানির ‘শান্তি’ দাতা -সংস্থার অর্থায়নে নির্মিত হয় এই মাটির বিদ্যালয়। অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা এর নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, এবং দীপশিখা প্রকল্পের কর্মীরা তাদের সহযোগিতা প্রদান করেন।
জার্মান স্থপতি আন্না হিয়ারিংগার এবং আইকে রোওয়ার্গ এই নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধান করেন।
২০০৭ সালে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার হিসেবে দীপশিখা প্রকল্পকে তেরো হাজার সাতশো মার্কিন ডলার, স্থপতি আন্না হিয়ারিংগারকে ষোলো হাজার পাঁচশ’ মার্কিন ডলার এবং স্থপতি আইকে রোজওয়ার্গকে আট হাজার দুইশ’ মার্কিন ডলার প্রদান করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এক দশক আগেও রুদ্রাপুর গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। গ্রামের শিশু-কিশোরদের ছয় থেকে সাত কিলোমিটার দূরের পাশের গ্রামের স্কুলে হেঁটে যেতে হতো। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে কৃষিকাজসহ অন্যান্য পেশায় জড়িয়ে পড়তো।
শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত করার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর দীপশিখা (নন-ফরমাল এডুকেশন ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ সোসাইটি ফর ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট) নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রুদ্রাপুর গ্রামে ছোট পরিসরে ‘মেটি স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করে। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নাচ, গান, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, দলীয় আলোচনা, এবং ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন হস্তশিল্প শেখানো হয়। বর্তমানে শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদান করা হয়। এই স্কুলের লক্ষ্য হলো আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষাদান, শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা, যুক্তিবাদী চিন্তার বিকাশ এবং দলগতভাবে জ্ঞানার্জন।
২০০২ সালে রুদ্রাপুর গ্রামে গবেষণার কাজে অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যানা হেরিঙ্গারসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী আসেন। গবেষণা শেষে অন্যরা ফিরে গেলেও অ্যানা হেরিঙ্গার তার গবেষণা ও স্থাপত্যবিদ্যার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে রুদ্রাপুরের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে একটি বিদ্যালয় নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে জার্মানির উন্নয়ন সংস্থা ‘শান্তি’ এবং বাংলাদেশের বেসরকারি সেবা সংস্থা দীপশিখা।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিরল উপজেলার রুদ্রাপুর গ্রামে মেটির অত্যাধুনিক মাটির স্কুলঘর নির্মাণ কাজ শুরু হয়, জার্মানির ‘শান্তি’ দাতা-সংস্থার অর্থায়নে। অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা এই নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, এবং দীপশিখা প্রকল্পের কর্মীরা তাদের সহযোগিতা প্রদান করেন। জার্মান স্থপতি অ্যানা হেরিঙ্গার এবং এইকে রোওয়ার্ক এই ভবনের নকশা প্রণয়ন করেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মাঠে সবুজ ঘাস। চারপাশে ফুলের সমারোহ। পাখির কিচিরমিচিরে অপরূপ পরিবেশ। শীতল আবহাওয়া। কোনো কোলাহল নেই।
ভবনের পেছনের দিকটায় রয়েছে ‘আনন্দালয়’ নামের একটি কমিউনিটি থেরাপি কেন্দ্র। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি সুপারির গাছ পেরিয়ে মাটির তৈরি এই ভবনের কাছে পৌঁছলে দৃষ্টি অবধারিতভাবে আটকে যায়। নিচতলাটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ব্যবহৃত হয়। ঘরের ভেতর মাটির তৈরি গুহাও রয়েছে, যেখানে শিশুরা খেলাধুলার মাধ্যমে আনন্দে মেতে ওঠে। এই গুহায় চলাফেরার সময় প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একপ্রকার ব্যায়াম হয়, যা তাদের চিকিৎসার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভবনটিতে আলো ও বাতাসের অবাধ সঞ্চারণের ব্যবস্থা রয়েছে, এবং ঘরগুলো পরিবেশবান্ধব। প্রতিবন্ধীদের সুবিধার্থে চলাচলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে।
দ্বিতল ভবনটির নকশা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন প্রতিবন্ধী ও হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীরা সহজেই এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে এবং এক তলা থেকে অন্য তলায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে অবাধে যাতায়াত করতে পারেন।
আনন্দালয়ের দক্ষিণে রয়েছে একটি পুকুর, আর পশ্চিম-উত্তর দিকে অবস্থিত মেটি স্কুল, যা একটি দ্বিতল ভবন। উভয় ভবনই একই স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। এছাড়া, এলাকায় রয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের জন্য পৃথক কক্ষ, অফিস কক্ষ এবং নামাজ ঘর।
দীপশিখা মেটি স্কুলটি প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। এ সময়ে ফ্রিতেই ঘুরে দেখতে পারেন দর্শনার্থীরা। তবে, সাথে করে কোনো খাবার বহন করা যাবে না।
ঢাকা থেকে আগত রহমান সোহেল বলেন, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। অনেকদিন ধরেই আনন্দালয় ও মেটি স্কুল দেখার ইচ্ছে ছিলো। সত্যি বলতে, মাটির তৈরি ঘর এতটা মনোমুগ্ধকর হতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
তার সঙ্গী সুমনা জানান, শুধু মাটির তৈরি ঘরই নয়, এই এলাকার নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ অত্যন্ত উপভোগ্য। এখানে এসে মন প্রশান্তিতে ভরে গেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে দীপশিখার কার্যক্রম প্রশংসনীয়।
দর্শনার্থী অনিক বলেন, আগে এই স্কুলের অনেক নাম শুনেছিলাম, তাই পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছি। মাটি ও বাঁশের তৈরি এই স্কুলের কারুকার্য ও নির্মাণশৈলী সত্যিই বিস্ময়কর।
বিরলের মঙ্গলপুর ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, দীপশিখা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালে। প্রাথমিকভাবে এর লক্ষ্য ছিলো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ভূমিহীন, প্রান্তিক কৃষক, শ্রমজীবী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করা।
১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন লাভ করে দীপশিখা। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে সংগঠনটি ছোট পরিসরে প্রতিষ্ঠা করে মডার্ন এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (মেটি) স্কুল। এই স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্থানীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি নাচ, গান, অভিনয়, বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দীপশিখা প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্মাণ করে পরিবেশবান্ধব কমিউনিটি থেরাপি কেন্দ্র ‘আনন্দালয়’, যার যাত্রা শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর। এই কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী শিশুদের পুনর্বাসন, ক্ষমতায়ন ও নাগরিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ফিজিওথেরাপি, ব্যায়াম ও শিক্ষা প্রদান করা হয়। ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ভবন প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী ও সহজপ্রবেশ্য। দ্বিতল ভবনের উপরের তলায় রয়েছে নারীদের জন্য টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট।
আনন্দালয়ের ‘ইমপ্রুভিং দ্য লাইভস অব পিপল উইথ ডিসঅ্যাবিলিটি (আইএলপিডি)’ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে হংকংয়ের কাদেরী চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন। এই প্রকল্পের আওতায় পল্লি এলাকার অতি দরিদ্র, বিশেষ করে ভূমিহীন, দিনমজুর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী (সমতলের নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী, শিশু, কিশোর, নারী ও প্রতিবন্ধী) ৫০০টি পরিবার রয়েছে।
প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হলো প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের শারীরিক ক্ষমতা ও চলাচলের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাসস্থানের পরিবেশগত অবস্থার উন্নয়ন, স্কুলে সমন্বিত ও সহায়ক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করে শিক্ষা অব্যাহত রাখা, জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি, প্রতিবন্ধী ও তাদের অভিভাবকদের আয় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি এবং কমিউনিটি পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সচেতনতা বাড়ানো। এ লক্ষ্যে আনন্দালয় ফিজিওথেরাপি সেবা, শিক্ষা সহায়তা, সমন্বিত জীবিকা উন্নয়ন, সচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন উদ্যোগ পরিচালনা করছে।