রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে আলওয়ার জেলার একটা গ্রাম সমুচী। গ্রামের সব থেকে বড় পাকা দোতলা বাড়ি।
এই দোতলা বাড়িটি ভরতপুর লোকসভা আসন থেকে সদ্য নির্বাচিত এমপি সঞ্জনা জাটভের। দেশটির সবচেয়ে কম বয়সী আইনপ্রণেতা হওয়ায় ফল ঘোষণার পর থেকেই খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন তিনি। নাম সঞ্জনা জাটভ। বয়স ২৬। বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ভজন লাল শর্মার জেলায় তার দলের প্রার্থী তথা প্রাক্তন এমপি রামস্বরূপ কোলিকে হারিয়েছেন তিনি।
সঞ্জনা জাটভ ১৯৯৮ সালের পয়লা মে ভরতপুর জেলার ভুসাওয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া সঞ্জনার বিয়ে হয় ২০১৬ সালে, ভরতপুর সীমান্ত সংলগ্ন আলওয়ার জেলার সমুচী গ্রামে।
বিয়ের আগে থেকেই তার স্বামী কাপ্তান সিং রাজস্থান পুলিশে কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন। স্বামীর উৎসাহে বিয়ের পরে স্নাতক হন সঞ্জনা। তার ইচ্ছা ছিলো সরকারি চাকরিতে ঢুকবেন।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সঞ্জনা জাটভ বলেন, শ্বশুরবাড়িতে কখনও আমাকে পুত্রবধূ বলে মনে করা হয়নি, পরিবারের মেয়ে হিসাবেই দেখা হয়েছে। আমাকে পড়াশোনা করতে দিয়েছেন এরা। স্বামী সরকারি চাকরিতে ছিলেন বলে, আমিও সরকারি চাকরি করবো, এমনটাই ভাবতাম। তবে ভাগ্য যা ঠিক করে রেখেছে, বাস্তবে তো সেটাই হওয়ার, তাই না?
স্বামী পুলিশ কনস্টেবল কাপ্তান সিংয় বলেন, বিয়ের পরেও আমি ওকে স্নাতকস্তরের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলি। নারীদের সম্পর্কে আমাদের পরিবারে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা রয়েছে। সঞ্জনা রাজনীতিতে সময় দিতে চাননি, কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম যে সঞ্জনা রাজনীতিতে যাক, পরিবার আর গ্রামের নাম উজ্জ্বল করুক।
সঞ্জনা জাটভ যে শুধু স্নাতক ডিগ্রি পেয়েছেন, তা নয়। এরপরে তিনি আইন পড়েছেন, এলএলবি ডিগ্রিও পেয়েছেন। তার কথায়, এসবই সম্ভব হয়েছে আমার স্বামী সবসময়ে পাশে থেকেছেন বলে।
সঞ্জনা জাটভের শ্বশুরবাড়ি যৌথ পরিবার। সেখানে তাকে স্ত্রী, পুত্রবধূ আবার দুই সন্তানের মায়ের দায়িত্বও পালন করতে হয়।
তিনি বলেন, আমি যখন রাজনীতির কাজে যাই, তখন শাশুড়িই সন্তানদের দেখাশোনা করেন। তবে আমি কিন্তু ঘরের কাজও করি আবার রাজনীতিও করি।
এখনতো তাকে দিল্লি যেতে হবে, আবার ভরতপুরেও যেতে হবে। সন্তানদের বা পরিবারকে কী করে সময় দেবেন?
সঞ্জনা জাটভের উত্তর দিল্লিতে থাকলে সেখানকার কাজ করবো, আবার ভরতপুরে থাকলে সেখানকার কাজ করতে হবে। কিন্তু যখন বাড়িতে থাকবো, তখন পুরো সময়টাই সন্তানদের আর পরিবারের।
ভোটের ফল ঘোষণার পরে সঞ্জনার একটি ভিডিও খুব ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে তাকে নাচতে দেখা যায়। ওই ভিডিও সম্পর্কে বলেন, এত আনন্দ হয়েছিল যে আমি নাচতে শুরু করেছিলাম।
জেলা পরিষদ সদস্য থেকে এমপি
সঞ্জনা জাটভ বলেন, আমার বাবা ট্রাক্টর চালাতেন। বাপের বাড়ির দিকে কেউ কখনও রাজনীতি করেন নি। তবে, বিয়ের পর যখন তিনি শ্বশুরবাড়িতে আসেন, তখন তার মামা শ্বশুর ছিলেন গ্রামের ‘সরপঞ্চ’ (গ্রামপ্রধান)। সেই থেকেই আমার প্রথম রাজনীতির প্রথম পাঠ শুরু হয়।
তিনি আলওয়ার জেলা পরিষদের সদস্য ছিলেন আর সেটাই ছিল রাজনীতিতে তার প্রথম সিঁড়ি।
রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর 'লড়কি হুঁ লড় সক্তি হুঁ' (আমি নারী, কিন্তু লড়াই করতে জানি) অভিযানেও যোগ দিয়েছিলেন।
গত বিধানসভা নির্বাচনে আলওয়ারের কাঠুমার আসন থেকে চারবারের বিধায়ক বাবুলাল বৈরওয়ার টিকিট কেটে দিয়ে সঞ্জনা জাটভকে প্রার্থী করেছিলো কংগ্রেস দল। কিন্তু নির্বাচনে তিনি মাত্র ৪০৯ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান।
বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর লোকসভায় তিনি জিততে পারবেন, এমন আশা কীভাবে করেছিলেন, এই প্রশ্নের জবাবে সঞ্জনা বলেন, জনগণ আমাকে অনেক ভালবাসা আর সাহস জুগিয়েছে। বিধানসভা ভোটে হেরে গেছি বলে মনেই হয়নি। দলও মনে করে নি যে আমি একজন পরাজিত প্রার্থী ছিলাম। তাই আমাকে এমপি টিকিট দিয়েছে। দলের বিশ্বাসের কারণেই আমি আজ এই জায়গায় আসতে পেরেছি।
মুখ্যমন্ত্রীর নিজের জেলায় পরাজিত বিজেপি
সঞ্জনা জাটভের জয়ের পরে সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে তার কম বয়স নিয়ে। তবে রাজস্থানের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হল যে তিনি বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ভজন লাল শর্মার জেলায় তার দলের প্রার্থী তথা প্রাক্তন এমপি রামস্বরূপ কোলিকে হারিয়েছেন।
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী জন লাল শর্মার নিজের জেলা ভরতপুরে বিজেপির প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে সঞ্জনা বলেন, আমি তো তাকে পরাজিত করিনি, জনগণ হারিয়েছে তাকে। তবে শুধু তার নিজের জেলায় নয়, তার নিজের গ্রাম আটারি গ্রামের তিনি পরাজিত হয়েছেন। সেখান থেকেও আমি বেশি ভোট পেয়েছি।
তার তরুণ বয়স এবং রাজনীতিতে তেমন একটা অভিজ্ঞতা না থাকায় ভরতপুরের উন্নয়নও বাধার সম্মুখীন হতে পারে, এরকম একটা আশঙ্কা নিয়ে আলোচনা চলছে।
তবে সঞ্জনা জাটভ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, আমি ভরতপুরকে উন্নয়নের নতুন দিশা দেখাব।
লোকসভা নির্বাচনের তিন দিন আগে ২৬ বছরে পা দেন সঞ্জনা জাটভ। এর আগে রাজস্থানের কংগ্রেস নেতা শচীন পাইলট ২৬ বছর বয়সেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সবচেয়ে কম বয়সী এমপি হওয়ার রেকর্ডটি এতদিন তারই দখলে ছিলো।
সঞ্জনা জাটভ বলেন, দুটি রেকর্ডেই নিজের জায়গায় থাকবে।
সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে শচীন পাইলট বলেন, আমিও ২৬ বছর বয়সে সংসদ সদস্য হয়েছিলাম। এখন সঞ্জনা আমার থেকেও কম বয়সে এমপি হয়েছেন। এইসব রেকর্ড তো গড়েই ওঠে অন্য কেউ তা ভাঙবে, তার জন্যই। আমি খুশি যে দলিত, দরিদ্র পরিবারের এক নারী সংসদ সদস্য হয়েছেন।