মুক্তিযুদ্ধের বার্তাকে বিশ্বের কাছে জানান দিতে নিজের জাহাজে নিজেই আগুন দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ জাকারিয়া। ছিলেন শিপিং ব্যবসায়ী। ৭১ সালের জুলাইয়ে মংলায় তার জাহাজ সপ্তডিঙ্গায় আগুন দেয়ার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের বার্তা ছড়ায় বিশ্ব গণমাধ্যমে। আর জাকারিয়ার আসল যুদ্ধটা শুরু হয় ৭১ এর পর। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত জাহাজের ঋণ শোধ করতে হয় তাকে। অথচ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটাও পাননি মোহাম্মদ জাকারিয়া।
শাহবাজপুর জমিদার বাড়ির তৃতীয় প্রজন্মের সন্তান মোহাম্মদ জাকারিয়া। দেশভাগের সময় বাবা চলে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের পানেশ্বরে। মোহাম্মদ জাকারিয়া যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়েন তখন তার মা মারা যান। বাবা গ্রামে থাকলেও আট ভাই বোনকে নিয়ে তিনি থাকতেন চাচা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তৎকালীন ডিআইজি আবুল হাসনাত শামসুল আলমের বাসায়।
জুবলি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে থাকতেই বন্ধুত্ব হয় বিশিষ্ট চিকিৎসক ও মুক্তিযোদ্বা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে। আমৃত্যু অটুট ছিলো সেই বন্ধুত্ব।
মোহাম্মদ জাকারিয়া ১৯৬৮ সালে পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করে আর ঋণ নিয়ে কেনেন দুটি তেলবাহী জাহাজ; সপ্তডিঙ্গা আর ময়ূরপঙ্খী। শুরু করেন শিপিং ব্যবসা। দেশ তখন উত্তাল। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একই বছরের মার্চ মাসে দেখা হয় ঢাকা কলেজের ভূগোল শিক্ষক আলতাফুন্নেসার সাথে। এক দেখাতেই পছন্দ করে বিয়ের প্রস্তাব দেন জাকারিয়া। যুদ্ধ শেষে শুরু হয় তাদের পথচলা।
এদিকে ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সেক্টর কমান্ডার এবং কে ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের দুটি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ঢাকায় আসেন।
এক সাক্ষাৎকারে জাফরুল্লাহ নিজেই বলেন, আমার বন্ধু জাকারিয়া কোনো চিন্তা না করেই বললেন; মুক্তিযোদ্ধারা চাঁদপুর থেকে খুলনা যাবার পথে আমার জাহাজে আক্রমণ করতে পারবে। তেলভর্তি জাহাজ মাসব্যাপী জ্বলতে থাকলে এটি বিশ্বের সামনে মুক্তিযুদ্ধে একটি সফলতার প্রতীক হবে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ও মোহাম্মদ জাকারিয়ার স্ত্রী অধ্যাপক আলতাফুন্নেছা বলেন, পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি করে সাথে ঋণ নিয়ে স্পেশালাইজড শিপিং এন্ড ট্রেডিং কোং লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির অধীনে জাপান থেকে দুটি নতুন জাহাজ নির্মান করে আনা হয়।
তিনি আরও বলেন, এরমধ্যে ময়ূরপঙ্খী বিমানের তেল পরিবহনের জন্য বিশেষ কাটিংয়ে নির্মাণ করা হয়। ১৬ জুলাই ১৯৬৯ থেকে বার্মা স্টার্টার চার্টার এ চলাচল করে করতে আরম্ভ করে জাহাজ দুটি। ১৯৭১ সালে মংলায় জাহাজটিতে মুক্তিযুদ্ধারা আগুন ধরিয়ে দেয়।
জাহাজটি পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনে ইন্স্যুরেন্স করা ছিলো। এর মূল কাগজপত্রের শর্ত অনুসারে গচ্ছিত থাকে তাদরে কাছেই। পিকিক টাকা তুলে নেয় পাকিস্তান ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে।
১৯৭১ সালে যে ঋণের পরিমাণ ছিলো ২৫ লাখ ৬৬৩৮ টাকা, পরবর্তীতে নবসৃষ্ট বাংলাদেশে শিল্প ঋণ সংস্থা থেকে ঋণগ্রহণ না করার সত্ত্বেও নতুন করে সম্পূর্ণ ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় পরিবারটির ওপর। পিকিক টাকা তুলে একটি সংস্থার বহুগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ঋণ পরিশোধ করতে হয়।
এটি সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র ঘটনা যেখানে দেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করতে নিজের জাহাজ নিজেই জ্বালিয়ে দেন স্বয়ং জাহাজ মালিক। কিন্তু যুদ্ধের পর কি হলো?
স্ত্রী আলতাফুন্নেসা বলেন, কর্নেল তাহের, আতাউল গণি ওসমানী এবং কয়েকজন মিলে পরিকল্পনা করেন যে, কি করে যুদ্ধের ভয়াবহতা প্রকাশ করা হয়। তখন তাকে (মোহাম্মদ জাকারিয়া) ডেকে জিজ্ঞেস করা হয়, 'তোমার কোনো আপত্তি আছে?' তখন তিনি বলেন, না, দেশের জন্য উৎসর্গ করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
অধ্যাপক আলতাফুন্নেসা আরও বলেন, তখন মাত্র দুই বছর হয়েছে মোহাম্মদ জাকারিয়া জাহাজ কিনেছেন। গ্রামগঞ্জের সমস্ত জায়গাজমি বিক্রি করে তিনি জাহাজ কিনেছিলেন। সেই মানুষের অন্তর এতো বড়। সেই জাহাজ কতোদিন ধরে জ্বললো, কিন্তু আমরা তা কোনোদিন জানতাম না। পরে ম্যাগাজিনে জাফরুল্লাহ ভাইয়ের লেখা থেকে বিষয়টি জানতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক এমজি ওসমানী তাকে সনদ দিতে চাইলেও রাজি হননি জাকারিয়া। কোনো সরকারই তার জাহাজের ক্ষতিপূরণ দিতে এগিয়ে আসেনি। বরং ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সেই জাহাজের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করে যেতে হয়েছে পরিবারটিকে।
দীর্ঘ দুই যুগ অসুস্থ থাকার পর গেলো বছর মারা যান প্রচার বিমুখ মানুষ মোহাম্মদ জাকারিয়া। কিন্তু এই না পাওয়া নিয়ে কোনো দু:খ নেই তার প্রবাসী দুই সন্তানেরও।
অধ্যাপক আলতাফুন্নেসা বলেন, এমজি ওসমানী নিজেই সমস্ত ঘটনা জানতেন, যেহেতু উনারাই পরিকল্পনা করেছিলেন। পরে এমজি ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য নিজেই ডেকেছিলেন। তখন আমার স্বামী সার্টিফিকেট নিতে চাননি। তিনি বলেছিলেন, আমি আমার দেশের জন্য লড়াই করেছি। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। আমার মাটির জন্য আমি যুদ্ধ করেছি, অন্য কিছুর জন্য নয়।
মোহাম্মদ জাকারিয়ার মতো এমন লাখো মানুষের বহু আত্মত্যাগেই আমাদের স্বাধীনতা। যদিও মৃত্যুর পরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো স্বীকৃতি মেলেনি মোহাম্মদ জাকারিয়ার। আজও সেই আফসোস বয়ে বেড়ান তার স্ত্রী আলতাফুন্নেসা।