প্রাকৃতিক দুর্যোগের আসন সাতক্ষীরা-৪। সুন্দরবন ঘেরা শ্যামনগর এবং কালিগঞ্জ উপজেলার একাংশ নিয়ে এ আসনটির প্রধান ফ্যাক্টর দুর্বল বেড়িবাঁধ। জোয়ার ভাটার সঙ্গে জীবন চলে এখানের মানুষের। ভোটারদের স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি পূরণও শুরু হয়েছে। বর্তমান সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার জানান, কয়েকটি কাজ শুরু হয়েছে, বাকিগুলোও দ্রুত হয়ে যাবে।
এ আসনে আবারও জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচন নিয়ে এখনো দোটানায় বিএনপি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (জাপা) ও জামায়াতের একাধিক প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাই এখানে সবসময় লড়াই হয় চতুর্মুখী।
সুন্দরবন ঘেরা সাতক্ষীরা-৪ আসন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সাতক্ষীরা-৪ আসনটির ১২টি ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কালিগঞ্জ উপজেলার আটটি ইউনিয়ন। এই আসনে বেড়িবাঁধ সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভাঙন জলাবদ্ধতা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভোটাররা এসব থেকে মুক্তি চাইছেন।
তারা জানান, তাদের অবস্থা বদল হচ্ছে, কিন্তু গতি এতো ধীর যে একটি প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই আরেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়। এই এলাকার অর্থনীতি মূলত চিংড়ি চাষ এবং সুন্দরবন নির্ভর। সেসব নিয়েও এখানে বছরের পর বছরের পুরোনো সমস্যা রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর এখানে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের একাধিক প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। বর্তমানে এখানে টানা দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আছেন। এবারও বর্তমান সংসদ সদস্যসহ মনোনয়ন চান কমপক্ষে চার জন প্রার্থী।
এবার আসনটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নতুন মুখ আশা করছে স্থানীয় একাংশের নেতাকর্মীরা। গত পাঁচ বছরে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাজের মূল্যায়ন ও দলীয় নেতাকর্মীদের কাজের মূল্যায়নে এবার দলীয় মনোনয়নে তরুণ নতুন মুখ আসতে পারে- এমনটিও নির্বাচনী এলাকায় প্রচার রয়েছে।
তবে এ আসনের বর্তমান এমপির অনুসারী নেতাকর্মীরা দৃঢ় কণ্ঠেই বলছেন, বর্তমান এমপিই জনপ্রিয়তা দিয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগকে এই আসনটি উপহার দিতে পারবেন। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সাতক্ষীরার অধিকাংশ এমপি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের খোঁজ রাখেন না।
বর্তমানে টানা দুই মেয়াদে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম জগলুল হায়দার। তিনি ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন তিনি।
জগলুল হায়দার বলেন, সরকারের উন্নয়নে সুন্দরবন ঘেঁষা এ আসনের সাধারণ মানুষ খুশি। এই আসনে নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোন্দল নেই। প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, কিন্তু এখানে কোনো প্রতিহিংসা নেই। টানা ১০ বছর তিনি কাজ করছেন, মনোনয়ন পেলে তিনিই জয়ী হবেন।
এ আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট কয়েক জন প্রার্থী রয়েছেন যারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। এদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মাসুদা খানম মেধা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ আতাউল হক দোলনসহ আরও বেশ কয়েকজন।
১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে এখানে জিতেছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। নানা কারণে পুরোনো প্রার্থীরা সক্রিয় না থাকলেও এবার এই আসনে অন্তত তিনজন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির গোলাম রেজা নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
এরপর দুইবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এ আসন ফিরে পায়নি জাতীয় পার্টি। তবে এই আসনে জাতীয় পার্টির যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের প্রভাব থাকায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চতুর্মুখী হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
মহাজোট থেকে দলীয় মনোনয়ন পেতে এ আসনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সাবেক এমপি ও জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত এ এইচ এম গোলাম রেজা। আরও মনোনয়ন চাইবেন কালিগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মাহবুবর রহমানসহ আরও কয়েক জন। এই আসনে জাসদের প্রার্থী হিসেবে সাবেক অধ্যক্ষ আশেক ই এলাহী দলীয়ভাবে নির্বাচন করবেন বলে জেলা জাসদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন ছাড়া এর পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে বিএনপি কখনো এই আসন থেকে নির্বাচিত হতে পারেনি। তবে এবারের নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন বিএনপি নেতা কাজী আলাউদ্দিন।
এ ছাড়া সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাতক্ষীরা আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর সৈয়দ ইফতেখার আলী দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। তবে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত। এ কারণে সরাসরি বিএনপির নেতাকর্মীদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি।
সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে দু’বারের সংসদ সদস্য জামায়াতের গাজী নজরুল ইসলাম এবারও এ আসনে প্রার্থী, এমনটি ঘোষণা দলটির। তিনি ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
নবম সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সাতক্ষীরা-৫ আসনের শ্যামনগর উপজেলাকে কালিগঞ্জ উপজেলার আটটি ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করে সাতক্ষীরা-৪ আসনে বিন্যস্ত করে নির্বাচন কমিশন। এরপর অনুষ্ঠিত তিনটি সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয় পেলেও এ আসনে জয় পায়নি জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতের পক্ষ থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনে সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলামের নাম ঘোষণা করেছে। গাজী নজরুল ইসলাম জামায়াতের জেলা কর্মপরিষদ সদস্য ও শ্যামনগর উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হলেও জিততে পারেননি তিনি।
জেলার শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলার আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-৪ আসনে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা চার লাখেরও বেশি।