ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিসহ অন্যান্য সফরসঙ্গীরা এখন চিরনিদ্রায় শায়িত। নিজের জন্মস্থান মাশহাদ শহরের শিয়াদের মূল কবরস্থান ইমাম রেজার পবিত্র মাজারে রাইসিকে দাফন করা হয়। অন্যান্যদের দাফন করা হয়েছে তাদের নিজ নিজ শহরে। নিহতদের জন্য এখনও শোক চলছে গোটা ইরানজুড়ে।
ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু ও তার অধ্যায় শেষ হওয়ার পর, অনেক প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। রাইসির আকস্মিক মৃত্যুতে বিশ্ব ইরানের শোকে শামিল হলেও, জল্পনা-কল্পনা একেবারে তুঙ্গে। কে হবেন, ইরানের পরবর্তী আয়াতুল্লাহ অথবা সর্বোচ্চ নেতা? এ প্রশ্ন ঘুরছে বিশেষজ্ঞ মহলেও। কারণ এই পদে সম্ভাব্য উত্তরসূরি ছিলেন রাইসি।
খামেনির পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদে রাইসিই যাবেন বলে দৃঢ়ভাবে ধারণা করা হচ্ছিলো। কিন্তু, তার হঠাৎ মৃত্যু পাল্টে দিয়েছে এ অঙ্কের সমীকরণ। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ছেলে মোজতবা খামেনিই হবেন পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা। তবে সেটি হবে একটি বিপজ্জনক অধ্যায়।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে, অনেক বিশ্লেষকই বলেছেন, ৮৫ বছরের সর্বোচ্চ নেতাকে প্রতিস্থাপন করার জন্য মোজতবাকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই মোজতবা খামেনি তার বাবার সম্ভাব্য উত্তরসূরি বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো। রাইসির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই জল্পনা আরও বেড়েছে।
অনেকেই বলছেন, রাইসির মৃত্যুতে সহজ হয়ে উঠেছে মোজতবার পথ। ৫৫ বছর বয়সী মোজতবা খামেনি আয়াতুল্লাহ খামেনির ছয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র। তিনি ইরানের রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। মোজতবার লালনপালন এবং কর্মজীবন ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস আইআরজিসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
তিনি অল্প বয়সে আইআরজিসিতে যোগদান করেন এবং ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের পর তিনি বিশিষ্ট রক্ষণশীল ধর্মগুরুদের নির্দেশনায় শিয়া বৃত্তির প্রধান কেন্দ্র কওমে ধর্মীয় অধ্যয়ন করেন। এই প্রেক্ষাপট ইরানের রাজনৈতিক অভিজাতদের কট্টরপন্থি গোষ্ঠীর মধ্যে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
সাউথ ক্যারোলিনার ক্লেমসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আরাশ আজিজি বলেছেন, ২০০৯ সালে মোজতবাকে একজন সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসাবে কথা বলা শুরু হয়েছিলো তখন সেটিকে অনেকেই একটি সস্তা গুজব বলে মনে করেছিলো। কিন্তু সেই ধারণা আর নেই। তবে এটা এখন খুব স্পষ্ট যে, তিনি একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।
বার্লিনভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর মিডলইস্ট অ্যান্ড গ্লোবাল অর্ডারের পরিচালক আলি ফাথোল্লাহ-নেজাদ বলেন, রাইসিকে খামেনির উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হতো কিনা তা বলা খুব কঠিন। কিন্তু খামেনি দীর্ঘদিন ধরে তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে আসছিলেন, যা সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে তাকে গড়ে ওঠার সুযোগ দেয়ার আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দেয়।
ফাথোল্লাহ-নেজাদ বলেছেন, নিজের উত্তরসূরি হিসেবে মোজতবাকে দায়িত্ব দেয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে খামেনির। পর্দার আড়ালে মোজতবা একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
তিনি উল্লেখ করেছেন, ইরানের নেতৃত্ব স্থানীয়দের মধ্যে পারিবারিক শাসন নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। শাহের শাসনকে উৎখাত করার সময় ইসলামি বিপ্লবীরা পারিবারিক শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু এখন, রাইসির মৃত্যুতে খামেনির উত্তরসূরি হওয়ার পাশার দান উল্টে গেছে। মনোযোগ মোজতবার ওপর ফিরে এসেছে।
প্রকাশ্যে খুব বেশি না আসা, সংবাদে প্রায় উল্লেখ না থাকা এবং সরকারি কোনও দায়িত্বেও নেই। বিগত শতকের নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে মোজতবা আলোচনায় আসতে থাকেন। বিশেষ করে চলতি শতকের প্রথম দশকে ২০০৫ ও ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহমুদ আহমেদিনেজাদকে জেতাতে তিনি ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর এক উপদেষ্টার মতে, ২০০৯ সালে তৎকালীন আধাসামরিক বাহিনী বাসিজ মিলিশিয়ার কমান্ডার তায়েবের সমর্থনে মুজতবা সংস্কারপন্থীদের ওপর ক্র্যাকডাউন চালান। ২০২২ সালে নীতি পুলিশের হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যুর পর দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের সময়ও মোজতবার ভূমিকা প্রশ্ন তুলেছিলো।
মোজতবার যেভাবে উত্থান ঘটছিলো তাতে এই জল্পনা আরও দৃঢ় হয় যে, তিনি বাবার উত্তরসূরি হওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে ইরানের ধর্মীয় তাত্ত্বিক ও খামেনি বিষয়ক গবেষক মেহেদি খালাজি বলেন, মোজতবা খামেনির আয়াতুল্লাহ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তার মতে, মোজতবা খামেনির বয়স কম।
আয়াতুল্লাহ হওয়ার জন্য যেসব বৈশিষ্ট্য থাকাটা আনুষ্ঠানিকভাবে দরকার সেগুলো তার মধ্যে নেই। বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়ে জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা এবং নির্বাহী অভিজ্ঞতা মোজতবার নেই। এ ছাড়া আলী খামেনি এবং তার পূর্বসূরি রুহুল্লাহ খোমেনি পরিবারের কারও কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজতন্ত্রকে ‘অনৈসলামিক’ বলে খারিজ করে দিয়েছেন।
যাই হোক, আগামী জুনের শেষদিকে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং খামেনির উত্তরসূরি বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সামনে রেখে ইরানের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের পুনর্বিন্যাসে মোজতবা খামেনিই কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখবেন বলে ধারণা করছেন অনেকে। এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই ইরানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে।