মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভেতরকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই রহস্যজনকভাবে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান। ভূরাজনীতির প্রভাবশালী এই দুই ব্যক্তির মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
রোববার আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করে হেলিকপ্টারে করে তাবরিজে ফেরার পথে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের জোলফা এলাকার কাছে দুর্গম পাহাড়ে প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলমান সংঘাতে ইব্রাহিম রাইসি ও হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানের মৃত্যু ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠী
এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছিল তেহরান। বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, বাহরাইন ও ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অর্থ ও সমরাস্ত্রের অন্যতম যোগানদাতা ছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী। নতুন প্রেসিডেন্ট এতটা আগ্রাসী হয়ে উঠবেন কিনা, সেটা এখন বড় প্রশ্ন এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছে।
এসব গোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ও ইসরাইলি স্বার্থের জন্য ক্রমাগত হুমকি তৈরি করে আসছিল। এর মধ্যেই গত মাসে ইব্রাহিম রাইসির সরকার সরাসরি ইসরাইলের অভ্যন্তরে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলও ইরানের ইস্পাহান শহরে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
ইসরাইলে সরাসরি হামলার সাহস
গত মাসে সরাসরি ইসরাইলের অভ্যন্তরে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আগে কেউ কখনো কল্পনাই করতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ ইসরাইলে সরাসরি হামলার সাহস করতে পারে! সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন ইব্রাহিম রাইসি!
শুধু এই হামলা নয়, কয়েক দশক ধরে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট ইসরাইল ও পশ্চিমা দেশগুলো। এমনকি এই তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবও। আর পশ্চিমা এসব শক্তির কোনো তোয়াক্কা না করে পরমাণু কর্মসূচি আরও জোরদার করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ইব্রাহিম রাইসি।
এমনকি বেশ কয়েকবার ইসরাইলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলেন সদ্য নিহত ইরানি প্রেসিডেন্ট রাইসি। রাইসির মৃত্যুতে দেশটির পরমাণু কর্মসূচিতেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মধ্য এশিয়া ও ইউরোপীয় ভূরাজনীতিতে প্রভাব
রাইসির মৃত্যু শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয় বরং প্রভাব ফেলবে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপীয় ভূরাজনীতিতেও। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে যে বিপুল পরিমাণ ড্রোন ও সমরাস্ত্র সরবরাহ করেছিল তেহরান, এখন সেই পদক্ষেপ কতটা ধারাবাহিক থাকবে, সেই প্রশ্ন উঠেতে শুরু করেছে। এছাড়াও রাইসির নেতৃত্বে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংঘাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ইরান।
ইরানের অভ্যন্তরে অস্থিরতা
এদিকে, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় রাইসির নিহতের ঘটনায় ইরানের অভ্যন্তরেও অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা করছে কূটনৈতিক মহল। তারা বলছেন, প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখনই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এসব কূটনীতিকের মধ্যে একজন আমেরিকা সরকারের সাবেক স্টেট ফর হাউস বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জোয়েল রুবিন। ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর তিনি বলেছেন, রাইসি এবং তার সহযোগীদের মৃত্যুর নেপথ্যে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আগামী দিনে এই ঘটনা ইরানের রাজনীতি তো বটেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
রুবিন বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রাইসিকে। শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট হিসেবেই নন, আক্ষরিক অর্থেই খামেনি নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তাকে। যাতে তার অবর্তমানে ইরানের সবকিছু রাইসির ইশারায় পরিচালিত হয়। ফলে রাইসির মৃত্যুতে ইরানের পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করতে পারে।
আসন্ন নির্বাচনে নতুন চ্যালেঞ্জ
পশ্চিম এশিয়া এবং আমেরিকার বিদেশ নীতি নিয়ে গবেষণা করে বই লিখেছেন ত্রিতা পার্সি। তার মতে, রাইসির মৃত্যুতে ভাইস-প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপতির পদে উন্নীত হবেন। কিন্তু তার পরও ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করাতে হবে, যা মোটেই সহজ কাজ হবে না।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকারবিরোধী অবস্থান চরম আকার ধারণ করেছে দেশটিতে। সম্প্রতি যে সংসদীয় নির্বাচন হয়, তাতে ভোটই দিতে যাননি মানুষজন।
আর দুর্ঘটনার নেপথ্যে যদি জনগণের সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে, তাতেও অশান্তি ছড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ত্রিতা পার্সি।
ঘন কুয়াশার কারণে রোববার ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়। সফরসঙ্গীসহ রাইসি নিহত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর বিশ্বের বিভিন্ন নেতারা শোক প্রকাশ করছেন।
এখনও রাইসির মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নতুন কি মোড় নেবে, তা নিয়ে সুস্পষ্ট মন্তব্য করার জন্য যথেষ্ট সময় না গড়ালেও সামনে যে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কট আরও ঘনীভূত হতে চলেছে, তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।