ইরানে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমিরাব্দুল্লাহিয়ানসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। তাদের মৃত্যুর পর যে বিষয়টি বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তা হলো- প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহন করা হেলিকপ্টারটি যুক্তরাষ্ট্রের বানানো।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ‘বেল-২১২’ মডেলের একটি হেলিকপ্টার প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহন করছিলো। এতে পাইলটসহ ১৫ জন বসতে পারেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা ‘ইউএইচ-১এন’ হেলিকপ্টারের বেসামরিক সংস্করণ এটি। ইরানে এর আগে ২০১৮ সালে ‘বেল-২১২’ মডেলের একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় পড়ে, সেবার মৃত্যু হয়েছিলো চারজনের।
অ্যারোস্পেস কোম্পানি বেল টেক্সট্রন ১৯৬০ -এর দশকে ‘ইউএইচ-১ ইরোকোয়া’ মডেলের হেলিকপ্টারের বদলে উন্নততর বাহন হিসেবে কানাডার সামরিক বাহিনীর জন্য তৈরি করে বেল হেলিকপ্টার। একটি ইঞ্জিনের বদলে নতুন এই মডেলটিতে যুক্ত করা হয় দুটি ‘টার্বোশ্যাফট’ ইঞ্জিন। ফলে হেলিকপ্টারের শক্তি ও ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষণের নথিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে ‘বেল’ হেলিকপ্টার বাজারে এলে দ্রুতই তা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বহরে যুক্ত হয়।
‘বেল-২১২’ মডেলের হেলিকপ্টারটি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, যুদ্ধ সরঞ্জাম পরিবহন এবং ওয়াটার বোম্বিংসহ সকল ধরনের কাজে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া পণ্য পরিবহনে ‘বেল-২১২’ মডেলের হেলিকপ্টারটির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা ২২০ ঘনফুট এবং বাহ্যিক ক্ষমতা প্রায় দুই হাজার ২৬৮ কেজি।
বর্তমানে বেলের সবশেষ ‘সুবারু বেল-৪১২’ মডেলের হেলিকপ্টার তৈরি করা হয়েছে। এটি মূলত পুলিশ, চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজ, সৈন্য পরিবহন, জ্বালানি শিল্প ও অগ্নিনির্বাপণ কাজের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অ্যাভিয়েশন সেফটি এজেন্সির সূত্র অনুযায়ী, এই মডেলটি ক্রুসহ ১৫ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারে।
বিভিন্ন বেসামরিক সংস্থাও এখন ‘বেল-২১২’ মডেলের হেলিকপ্টারটি ব্যবহার করে। জাপানের কোস্ট গার্ড, যুক্তরাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, ফায়ার বিভাগ ও থাইল্যান্ড পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা এটি বর্তমানে ব্যবহার করছে। ইরান সরকারের কাছে এ ধরনের হেলিকপ্টার কতোগুলো আছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে ফ্লাইট গ্লোবালের ২০২৪ সালের হিসেবে, দেশটির বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর কাছে এ মডেলের ১০টি হেলিকপ্টার রয়েছে।
রোববার ইরানি প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ‘বেল-২১২’ মডেলের যে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটি সরকারি কর্মকর্তাদের বহনের উপযোগী করে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছিলো।
বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম ও জরিপ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ‘বেল-২১২’ মডেলের হেলিকপ্টারটির দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হবার বেশকিছু ঘটনা রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনাগুলো হচ্ছে, ১৯৮২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মেডিকেল ইভাকুয়েশন হেলিকপ্টারটি ভোরে প্রবল বৃষ্টিপাত ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে উত্তর সাগরে বিধ্বস্ত হয়। এসময় হেলিকপ্টারটিতে থাকা ৬ জন ক্রু সাগরের পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন।
২০১২ সালের ২০ জুলাই ব্রুনাইয়ের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, দেশটির বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত ‘বেল-২১২’ মডেলটির একটি হেলিকপ্টার স্বাভাবিক আবহাওয়ায় অনুমোদিত উচ্চতার নিচ দিয়ে ওড়ার কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ঘটনায় হেলিকপ্টারটিতে থাকা ১২ জন নিহত ও দুই জন সদস্য আহত হন।
বিমান চালনায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিষয় নিয়ে কাজ করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফ্লাইট সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ৮ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপকূলে ‘বেল-২১২’ মডেলের বেসরকারি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় পড়ে।
এরপর ২০১৮ সালে পারস্য উপসাগরে ইরানের ‘বেল-২১২’ মডেলের একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় পড়েছিলো। সেসময় হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে চার জনের মৃত্যু হয়।
সবশেষ রোববার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী ‘বেল-২১২’ মডেলের হেলিকপ্টারটি আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বাহনটিতে থাকা সবাই নিহত হন।