জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষ করে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায়, মানুষকে এখন সবচেয়ে বেশি মোকাবিলা করতে হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তীব্র দাবদাহ, খরা, দাবানলের সঙ্গে বেড়ে চলছে অতি বৃষ্টি, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়। আর এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মতো বদ্বীপ দেশগুলো।
ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব কত প্রলয়ংকারী হতে পারে, আবারো তার সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। সময় যত গড়াচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে প্রবল রিমালের ধ্বংসলীলা। দমকা বাতাস আর ভারী বৃষ্টি কমতে শুরু করার পর দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলার ক্ষত চিহ্নগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে।
রোববার রাত আটটার দিকে উপকূলে আছড়ে পরার ব্যাপক তাণ্ডব চালাতে শুরু করে রিমাল। আঘাত হানার পর কিছুটা দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে রূপ নিলেও, প্রায় ৩৬ ঘণ্টা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অবস্থান করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি চালায়।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক হিসাব সেরে ফেলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে দেড় লাখের বেশি বাড়িঘর সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৩৭ লাখ মানুষ। আর কেড়ে নিয়েছে দশটি প্রাণ।
প্রবল জোয়ারের তোড়ে বহু জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ উপকূলের বহু এলাকা। জলোচ্ছ্বাসের ১০ থেকে ১২ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায় বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা সেখানে। ভেসে গেছে উপকূলের বহু মাছের ঘের, প্লাবিত হওয়া উপকূলের নিম্নাঞ্চলে ঢুকে পড়েছে লবণাক্ত পানি।
১৫ বছর আগে বাংলাদেশের ভূমিতে ঘূর্ণিঝড় আইলা যে প্রলয় চালিয়েছিলো, রিমালের দীর্ঘসময় ধরে চালানো তাণ্ডবেও একই রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা মনে করছেন।
বাতাসের প্রায় ১২০ কিলোমিটার ঘূর্ণন গতি নিয়ে রোববার সন্ধ্যায় উপকূলে আঘাত হানে রিমাল। এরপর ধীরে ধীরে আগাতে শুরু করে সামনের দিকে। প্রথমেই তাণ্ডবের শিকার হয় বাংলাদেশের ঢাল হিসেবে পরিচিত সুন্দরবন। এরপর সাতক্ষীরা, যশোর, মাগুরা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ হয়ে টাঙ্গাইল ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট দিয়ে ভারতে আসামে চলে যায়।
তবে দীর্ঘ এই যাত্রাপথ ধীর গতিতে পার হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থলে উঠে যাওয়ার পরও বহু সময় ধরে দমকা বাতাস ও ভারী বর্ষণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকে। গাছের গোড়া দুর্বল হয়ে উপড়ে পড়তে থাকে। ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
শুধু খুলনাতেই ১২ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমির ধান, মসলা ও সবজিজাতীয় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে- আউশ ধানের বীজতলা, কলাগাছ, তিল, মুগডাল, মরিচ, আদা, হলুদ, চিনাবাদাম, ভুট্টা, পেঁপে, পান ও আখ।
ভারী বর্ষণে তালিয়ে যায় দেশের প্রধান বাণিজ্যিক ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। সেখানে সোমবার বিকেলে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ২০৫ মিলিমিটার। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে চাঁদপুরে ২৫৭ মিলিমিটার। রাজধানী ঢাকার অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের প্রথম ধাক্কাতে হুহু করে পানি ঢুকে পড়ে সুন্দরবনে। মুহূর্তেই নোনাপানির তোড়ে ভেসে যায় সেখানে থাকা ৮০টি মিঠাপানির পুকুর। বাদাবনের গাছপালাও নিমজ্জিত হয় পানিতে। আনর উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপকভাবে হরিণ ভেসে গিয়ে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
সোমবার বিকেলেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান খান ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব তুলে ধরেন। জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ১৯টি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আর দুর্যোগকবলিত স্থানে মানুষের সাহায্যে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার। দুর্গতদের চিকিৎসা দিতে এক হাজার ৪৭১টি মেডিক্যাল টিম গঠন করে মাঠে নামানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের অনুকূলে ছয় কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে সারা দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে প্রায় এক কোটি ৩১ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে সারা দেশে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রাহকদের সিংহভাগই পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকার পোল নষ্ট হয়েছে প্রায় চারশটি। আরো নষ্ট হয়েছে হাজারখানেক ট্রান্সফরমার। বিদ্যুতের স্প্যান ছিঁড়ে গেছে ৬২ হাজার ৪৫৪টি এবং মিটারে ভেঙেছে ৪৬ হাজার ৩১৮টি। বাতাস কমার পর শুরু হয়েছে পুনর্নির্মাণের কাজ।
পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে বহু রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। ব্যাহত হয়েছে মানুষের জীবিকা ও অর্থনৈতিক জীবন। উপকূলের মানুষের সামনে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন লড়াই; যেভাবে এর আগে ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের পর প্রতিবারই ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য সব গল্প তৈরি করেছেন তারা।