গাজা গণহত্যা শুরুর পর থেকে স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বিপজ্জনক মানসিক সংকটে ভুগছে ইসরাইলিরা। প্রতি চারজন ইসরাইলির মধ্যে একজন মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে যা আরও প্রকট হচ্ছে।
ইসরাইলি হাসপাতাল সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে ইয়াহু নিউজ ও পার্সটুডে বলছে, মানসিক রোগ ও অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার কারণে জায়নবাদী সমাজে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার।
ইসরাইলের নেতানিয়া শহরের মাদকাসক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাউল লরেন্ট বলেন, গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইসরাইলি নাগরিকদের মধ্যে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার মাত্রা বেড়ে গেছে। অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শে এই ওষুধ সেবন করছেন আবার কেউ নিষিদ্ধ ড্রাগের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন এবং জুয়া খেলে নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন। মানসিক চাপ কাটিয়ে ওঠার জন্য তাদের এই আচরণগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, মাদকাসক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একটি টিম ইসরাইলের বিভিন্ন শ্রেণির প্রায় এক হাজার মানুষের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে। ওই জরিপে দেখা গেছে, ইসরাইলি সমাজে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের মাদকের প্রতি মানুষের আসক্তি শতকরা ২৫ ভাগ বেড়ে গেছে। অর্থাৎ গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতি চারজন ইসরাইলির মধ্যে একজন মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর অর্থাৎ হামাসের আল-আকসা তুফান অভিযানের পর, ইসরাইলে ঘুমের ওষুধের ব্যবহার ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ১৮০ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে ৭০ শতাংশ বেড়ে যায়।
ঘুমের ওষুধ কিনতে আসা বেশিরভাগ ইসরাইলি জানান, তাদের সন্তান গাজায় যুদ্ধ করতে গেছে এবং তারা চিন্তায় ঘুমাতে পারছেন না। ভবিষ্যতে কী হবে? এ নিয়েও দুশ্চিন্তা তাদের।
সম্প্রতি ইউনি নামে এক তরুণকে গাজা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিল ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ব্যাপক মাদকাসক্তের কারণে তার যুদ্ধে যাওয়া পিছিয়ে যায়।
১৯ বছর বয়সী ইউনি জানান, করোনা মহামারির সময় থেকে তিনি মাদক নিচ্ছেন, কিন্তু গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার অবস্থা চরমে পৌঁছায়।
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ করতে যাওয়া আরেক ইসরাইলি সেনা ইয়াশির মাটান বলেন, আমি মাদক গ্রহণের মাধ্যমে সবকিছু ভুলে থাকতে চাই। আমি জানি যে, এই যুদ্ধের কোনো ফলাফল নেই তারপরও বাধ্য হয়ে এতে অংশগ্রহণ করেছি।
সম্প্রতি তেল আবিব থেকে প্রকাশিত হিব্রু দৈনিক হারেতজ জানিয়েছে, ইসরাইলের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের পক্ষ থেকে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ৭ অক্টোবর আল আকসা তুফান অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত ৪০ শতাংশ ইসরাইলি মারাত্মক মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
ইসরাইলের আচভা একাডেমিক কলেজ, হাইফা ইউনিভার্সিটি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ৭ অক্টোবরের অভিযানের পর থেকে প্রতি তিনজনে একজন ইসরাইলি নাগরিকের মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) বা এক ধরনের 'মানসিক আতঙ্কের' উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
গবেষকরা জানান, সমীক্ষায় অংশ নেয়া নাগরিকদের মধ্যে ৩৪ শতাংশের পিটিএসডির উপসর্গ রয়েছে। আর যারা সরাসরি চলমান পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত বা যাদের স্বজনরা হতাহত হয়েছে তাদের ৫০ শতাংশের মধ্যে পিটিএসডির লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
তারা বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে ইসরাইলের ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
এর আগে গেলো বছরের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে ইসরাইলে এই দশকের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান চালায় গাজার হামাস সরকার। এর পরপরই গাজায় বিমান হামলা ও স্থল হামলা শুরু করে ইসরাইল। এ আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। আহত লাখ ছাড়িয়েছে।
গাজা গণহত্যা শুরুর পর থেকে ইরান, চীন, রাশিয়া, বাংলাদেশ, নরওয়ে এর বিরোধিতা করে আসছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বহু ইউরোপীয় দেশ ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে আসছে।